দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি জানালেন, ‘ড. ইউনূস তাঁর পুরনো বন্ধু। নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের দ্বার উন্মোচন করতে মুখিয়ে আছে তাঁর দেশ। এখন থেকে বাংলাদেশ হবে মালয়েশিয়ার ‘কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’। অর্থাৎ কৌশলগত অংশীদার থেকে একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারি’ সম্পর্কে উন্নীত করার ঘোষণা দিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। গতকাল এক দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব ঘোষণা, অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশটির শ্রমবাজার খুলে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে ১৮ হাজার শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ পূর্বমুখী সহযোগিতা সম্পর্ক সম্প্রসারণে আসিয়ানের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপ’ হওয়ার যে প্রত্যাশা করছে, সেই প্রত্যাশা পূরণেও তিনি সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলাদেশি পণ্যে হালাল সার্টিফিকেশনে দক্ষতা বাড়াতে টেকনিক্যাল সহায়তার কথাও জানান।
এর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে একমত প্রকাশ করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। সেই সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সুখবর দেন তিনি। মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে তাঁর। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। দেশটির শ্রমবাজার নিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রথম পর্যায়ে ১৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়া হবে। সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, আমার পুরনো বন্ধু এবং বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু আসায় আমি খুবই খুশি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা প্রথম কোনো সরকার প্রধানের বাংলাদেশ সফর। প্রধান উপদেষ্টা জানান, নতুন বাংলাদেশ গঠনে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে তার অধিক্ষেত্র হবে তিনটি। রাজনীতি, ব্যবসা ও বিনিয়োগ এবং সংস্কৃতি- এই তিন খাতে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছি। তারুণ্যের শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছি। সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, এআই, সেমি কন্ডাক্টরসহ প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয় এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রপ্তানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্লু ইকোনমি এবং সেবা খাতসহ পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কথা বলেছি। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি এবং ভিসা সহজীকরণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
আসিয়ান জোটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মালয়েশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এটি শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ইস্যু নয়, এটি বৈশ্বিক ইস্যু। বিশ্ব ফোরামে এ নিয়ে উচ্চকিত হওয়া দরকার। প্রফেসর ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যে ছেলেটি সাত বছর আগে জন্ম নিয়েছে, সে এখন সাত বছরের শিশু। বাংলাদেশে আসার পর (রোহিঙ্গা) শিশুর সংখ্যা আরও বাড়ছে। এরা ‘অ্যাংরি চাইল্ড’ হিসেবে বেড়ে উঠছে, যাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
৫৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম দুপুর ২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁকে স্বাগত জানান। এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন।হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানোর পর সেখানে মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, ঢাকায় পুরনো বন্ধুকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুব খুশি। এ সময় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, আত্মত্যাগ এবং বিগত সরকারের গণহত্যা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেখানকার নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন। পরে তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে একই গাড়িতে চড়ে দ্বিপক্ষীয় ভেন্যুতে যান। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে পৌঁছার পর দুই দেশের সরকারপ্রধান ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পরে আনোয়ার ইব্রাহিম বক্তব্য দেন।
দুই নেতার সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে সাংবাদিকরা রোহিঙ্গা ইস্যু ও সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়া শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেন। জবাবে মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী জানান, তাঁর দেশের উন্নয়নে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তাদের আরও শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে। শ্রম রপ্তানি বন্ধের বিষয়ে তাঁর সরকার কোনো রাষ্ট্রকে দেখে না। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা যে নতুন প্রক্রিয়া অবলম্বন করছেন, সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে সে যে দেশই হোক শ্রম রপ্তানি করতে পারবে না। তিনি বলেন, তাঁর সরকার শ্রমিকদের আধুনিক দাস হিসেবে বিবেচনা করতে চায় না, সে বাংলাদেশ কিংবা অন্য যে কোনো দেশের হোক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী জানান, আসিয়ানের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র হিসেবে তাঁর দেশ সবসময় ওই অঞ্চলে প্রত্যেক রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আকাক্সক্ষা করে। এ আকাক্সক্ষার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুটি জড়িত। রোহিঙ্গা সংক্রান্ত ইস্যুতে তিনি আসিয়ানে তাঁর ভূমিকা আরও জোরদার করবেন। এমনকি বৈশ্বিক ফোরামেও এ ইস্যুতে তিনি বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশ আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপ হতে চায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে তিনি আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলবেন। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকলে তাও রাখবেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, অর্থ উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য, সিনিয়র সচিব ও এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আগত সফরসঙ্গীরা উপস্থিত ছিলেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। সংক্ষিপ্ত সফর শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন।