বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনতে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও যেসব দেশে বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপি, আমলারা অবৈধভাবে অর্থ পাচার করে জমি, ফ্ল্যাট কেনাসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানি গড়ে তুলেছেন, তাদের তথ্য সংগ্রহ ও পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনতে সরকারি দপ্তরগুলো মাঠে নেমেছে। কয়েকটি দেশে চিঠিও পাঠিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-বিএফআইইউ। এ লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার কথাও জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সূত্রগুলো জানায়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে দেশ থেকে
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি। এ লক্ষ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কূটনৈতিক প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চাইছেন। বিবৃতি দিয়ে বিগত হাসিনা সরকারের অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, এখনো পর্যন্ত যে দেশগুলোর কাছে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরত আনতে সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা করলে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে দেশটির সরকারের সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় আগের স্বৈরাচারী শাসনের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলেও ড. ইউনূস পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা চান।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, আমরা বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জানি যে শেখ হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার হয়ে গেছে। বিগত সরকারের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালীদের যুক্তরাজ্যে বাড়িঘর করার তথ্য রয়েছে। পাচার হওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে ফেরত আনা যায় সে বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। পাচার সম্পদ ফেরত আনতে বিশ্বব্যাংকের কাছেও প্রযুক্তি সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ সহায়তা চান। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ‘একনায়কতন্ত্রের’ শাসনামলে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চুরি করা কোটি কোটি ডলার পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আপনাদের কাছে চুরি হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার প্রযুক্তি রয়েছে। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঘুষ, দুর্নীতির টাকা ছাড়াও দেশের ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করার তথ্য রয়েছে। তবে পাচারকৃত এ অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ ও জটিল বলে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়েছে। এ কারণে প্রধান উপদেষ্টা চাইছেন ফেরত আনার আগে সেই সম্পদ সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সহায়তায় জব্দ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে, যাতে সম্পদগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডে না চলে যায়। এক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ ফেরত আনার লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ওই দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ জরুরি ভিত্তিতে ফ্রিজ করার জন্য কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে, ওই টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অর্থ ফেরত আনার পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়েও অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েকটি বড় গোষ্ঠী মিলে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ২ লাখ কোটি টাকার মতো বিদেশে পাচার করেছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী লন্ডনে ৩৬০টা বাড়ি কিনেছেন। তার ভাইও নাকি সমপরিমাণ বাড়ি কিনেছেন। দুবাই, নিউইয়র্কের ম্যানহাটন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতেও বাড়ি আছে। এ সম্পদগুলো কীভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি সেই চেষ্টা করছি আমরা।
গভর্নর বলেন, কিছু অর্থ বিভিন্ন গোষ্ঠী জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে গেছে, সেগুলো তো আমরা সহজে আনতে পারব না। সেক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে হবে।