শ্রীলঙ্কায় যখন এক গণঅভ্যুত্থান প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখন অনেকে সেটাকে এই দ্বীপ দেশের উপর তার প্রতাপশালী পরিবারের ১২ বছরের আধিপত্যর অবসান হিসেবে দেখে। এখন শ্রীলঙ্কা নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নামাল রাজাপাকসে প্রার্থী হয়েছেন।
এই ৩৮ বছর বয়সী হচ্ছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে এবং অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট গটাবায়া রাজাপাকসের ভাতিজা।
নামাল রাজাপাকসে নিজেকে পরিবর্তনের দূত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। কিন্তু অনেকেই তার প্রার্থিতাকে তার বিতর্কিত পরিবারের ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
এই পরিবারের রাজনৈতিক জীবন ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়েই বিধ্বস্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের বাড়ি-ঘরে হামলা করায়, পরিবারের কিছু সদস্য সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যরা সরকারে তাদের পদ ছেড়ে দেন। দুই কোটি মানুষের দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিক্ষেপ করার জন্য জনগণ তাদেরকে দোষারোপ করে।
দু’বছর পর এই পরিবার রাজাপাকসের উত্তরাধিকারীর মাধ্যমে আবার রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে। নামাল রাজাপাকসে নিজেকে উপস্থাপন করছেন এমন ভাবে যে, তিনি শ্রীলঙ্কার জন্য সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ এনে দিবেন।
নামাল রাজাপাকসের সিদ্ধান্ত
তবে নামাল রাজাপাকসের জন্য এটা শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়–এটা গভীরভাবে ব্যক্তিগত। রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক অভিযোগ, যে তারা দেশকে তাদের পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে পরিচালনা করে ২০২২ সালে অর্থনীতিতে ধস নামান, সেই অভিযোগ তিনি খণ্ডন করতে চান। একই সাথে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার রায়ও খারিজ করতে চান।
এএফপিকে নামাল জানান, ‘আমার বা আমার পরিবারের জন্য দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ বিষয় না। আপনি যদি এই দেশের সকল রাজনীতিকের দিকে তাকান বা আমাদের অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে…তাদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে।’
নামাল বলেন, ‘মানুষ বুঝতে পারবে, কারণ আপনি যদি বর্তমান সময়ের দিকে তাকান, সবাই একে অপরকে দোষারোপ করছে।’
শ্রীলঙ্কা এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিক আশার জায়গা ছিল। কিন্তু ঋণের বোঝা এবং কোভিড-১৯ মহামারির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মারাত্মক অভাব দেখা দেয় এবং ২০২২ সালে দেশটি অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়। সঙ্কট একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয় এবং বিক্ষুব্ধ মানুষ প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর আর অন্যান্য সরকারি ভবন দখল করে নেয়। গটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং পরে পদত্যাগ করেন।
সংসদে রাজাপাকসে পরিবারের তখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবং প্রেসিডেন্টের মেয়াদের বাকিটুকু সময় দায়িত্ব পালনের জন্য রানিল বিক্রমাসিংহেকে নির্বাচিত করা হয়। বিক্রমাসিংহে সংসদে আইন পাস করার জন্য তাদের সমর্থনের বিনিময়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এর ফলে রাজনীতিতে এই পরিবারের প্রত্যাবর্তন সম্ভব হচ্ছে।
নামাল বলেন, ‘আমারা পালিয়ে যাইনি, আমরা কখনো পালাই নাই। কিছু লোক মনে করেছিল আমরা লুকিয়ে আছি।’
দলের উপর রাজাপাকসেদের মালিকানা
জয়ের জন্য নামালের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে, কারণ প্রতিযোগিতা হবে মূলত অন্য তিন প্রার্থীর মধ্যে বিক্রমাসিংহে, সংসদে বিরোধী দলের নেতা এবং একজন বামপন্থি নেতা যার শক্তিশালী জোট আছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের শ্রীলঙ্কা বিষয়ক সিনিয়র কন্সাল্টান্ট অ্যালান কিনান বলছেন, প্রেসিডেন্টে পদের জন্য তরুণ রাজাপাকসের প্রার্থিতা হচ্ছে একটি পরীক্ষামূলক প্রচারণা, যেটা পরিবারের ‘উত্তরাধিকারী হিসেবে তার অবস্থান’ পাকাপোক্ত করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা (রাজাপাকসেরা) জানে নামাল জিতবে না। কিন্তু তার প্রার্থিতা দলের উপর পরিবারের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।’
কয়েক দশক ধরে রাজাপাকসে পরিবার শ্রীলঙ্কার রাজনীতির একটি স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তারা প্রায় সবকিছুর উপর প্রভাব ফেলে-আমলাতন্ত্র থেকে আদালত, পুলিশ, ব্যবসা এবং ক্রীড়াঙ্গন।
নামাল রাজাপাকসের বাবা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তারপর ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ২৬ বছরের রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে পরাজিত করার জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিনহালা জনগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে ২০১৫ সালে তিনি পরাজিত হন।
মাহিন্দা আর গটাবায়া
কিন্তু চার বছর পর পরিবার আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে, যখন মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গটাবায়া রাজাপাকসে ২০১৯ সালে ইস্টার রবিবারে বোমা হামলার জন্য ইসলামিক উগ্রবাদীদের দায়ী করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিনহালা জনগোষ্ঠীকে উত্তেজিত করে তোলেন। বোমা হামলায় ২৯০ জন নিহত হয়।
কিন্তু অর্থনীতির পতন আর তামিল, মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হওয়ায় পরিবারের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
নামাল রাজাপাকসে একজন তরুণ, আধুনিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে চান, পরিবারের কলুষিত অতীত থেকে নিজেকে দূরে রেখে। তার প্রচেষ্টায় তার বাবার কাজ প্রতিফলিত হচ্ছে। মাহিন্দা রাজাপাকসে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্য এখনো কিছু ভোটারদের মাঝে জনপ্রিয়।
তার বাবার মত, নামাল রাজাপাকসে বৌদ্ধ সিনহালা সংস্কৃতি তুলে ধরে পোশাক পরেন-ঘারে একটি খয়েরি রঙের স্কার্ফ, সাদা সারোং আর জামা। প্রচারণার সময় তাকে তার বাবার পা স্পর্শ করতে দেখা যায়, যে প্রথা স্থানীয়রা শ্রদ্ধা করে।
তিনি দেশকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা ডিজিটাল করে দুর্নীতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
তারপরও শ্রীলঙ্কার অনেকেই এই পরিবারের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। রাজাপাকসের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে জনমত সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে তামিল সম্প্রদায়ের মাঝে, যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ।
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা।