শাহরিয়ার রাজ :
ছাগলকান্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যের নামে থাকা আরও ২৩.৬৭ একর জমি, ব্যাংকে থাকা প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ও ৪টি ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য সম্পত্তি জব্দের (ক্রোক) আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। দুদকের আদালত পরিদর্শক আমির হোসেন জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন এসব সম্পত্তি জব্দের আবেদন করে। এ বিষয়ে শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন আদালত। এদিন মতিউরের সম্পত্তি জব্দের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, মতিউর রহমানের সম্পত্তির অনুসন্ধানকালে জানা যাচ্ছে যে, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন। যেটি করতে পারলে অত্র অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা দায়ের ও বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তাই সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর সম্পত্তিসমূ হ ক্রোক (জব্দ) করা প্রয়োজন। এর আগে গত ৪ জুলাই মতিউর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ১০.৩৫ একর জমি ও চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন আদালত। এ নিয়ে দুই দফায় মোট ৩৪.০২ একর জমি ও রাজধানীতে থাকা ৮টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেওয়া হলো।
দ্বিতীয় দফায় জব্দ হওয়া স্থাবর সম্পত্তি : দ্বিতীয় দফায় জব্দের আদেশ দেওয়া স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৩৬৭ শতক বা ২৩.৬৭ একর জমি এবং রাজধানীর মিরপুরে থাকা ৪টি ফ্লাট। এসব জমি সাভার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও নাটোরের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বলে নথি সূত্রে জানা গেছে।
কার নামে কত জমি : জব্দ হওয়া জমির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জমি রয়েছে মতিউরের ভাই এম এ কাইউম হাওলাদারের নামে। মেসার্স গ্লোবাল সুজ লিমিটেডের পক্ষে তার নামে রয়েছে ৮৯২ শতাংশ জমি। এ ছাড়াও মতিউর-লায়লা দম্পতির ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে রয়েছে ৫১৫.৮৩ শতাংশ (৫.১৬ একর) জমি। এ দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতার নামে পাওয়া গেছে ১৮৮.৪৯ শতাংশ জমি। মতিউরের আপন ভুবন শুটিং স্পটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মনোয়ার হোসেনের নামে ১৬৬.৭২ শতাংশ জমি।
এ ছাড়াও মতিউরের নামে থাকা ১৫২ ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা ২৩৯.১৩ শতাংশ জমি রয়েছে জব্দের তালিকায়। এদিকে মতিউর-লায়লার নামে যৌথভাবে থাকা ৪৮.১৬ শতাংশ এবং মতিউর-লায়লা-অর্ণবের নামে যৌথভাবে থাকা আরও ৪৫.১৬ শতাংশ জমিও রয়েছে জব্দের আদেশ হওয়া স্থাবর সম্পত্তির তালিকায়।
কোথায় কত জমি : মতিউর ও তার পরিবারের সদস্য ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকার সাভারে ২৬.৬১ শতাংশ, ময়মনসিংহের ভালুকায় ১ হাজার ৬২ শতাংশ, গাজীপুরে ৮৭৫.৯৫ শতাংশ, নরসিংদীর শিবপুরে ২৩৬ শতাংশ এবং নাটোরের সিংড়ায় ১৬৬ শতাংশ জমি রয়েছে।
গাজীপুরে শুটিং স্পট, ভালুকায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান : জব্দ আবেদনের নথি সূত্রে জানা যায়, মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরে রয়েছে ‘আপন ভুবন’ নামে ৬.৩৬ একর জমির ওপর একটি শুটিং স্পট। এসব জমির মধ্যে ১৫২ শতাংশ জমি খোদ শুটিং স্পটের নামে দলিল করা। শুটিং স্পটের বাকি ৪৮৪.৩৬ শতাংশ জমি মতিউর পরিবারের সদস্যের নামে। এ ছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী মৌজায় রয়েছে মেসার্স গ্লোবাল সুজ লিমিটেড নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এ কোম্পানির নামে রয়েছে ৬৬ শতাংশ জমি এবং কোম্পানির পক্ষে মতিউরের ভাই কাইউম হাওলাদারের নামে রয়েছে ৮৯২ শতাংশ বা ৮.৯২ একর জমি।
জব্দ হয়েছে ৪ ফ্ল্যাট : রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের শেলটেক বিথীকা টাওয়ারে মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা চারটি ফ্ল্যাট ও গাড়ি পার্কিং স্পেস রয়েছে জব্দের খাতায়। এ চারটি ফ্ল্যাটের প্রতিটির আয়তন ১৮১২ বর্গফুট। এ ফ্ল্যাটগুলো ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর কেনা হয়।
অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা অস্থাবর সম্পদ : মতিউরের অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১১৬টি পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা এবং শেয়ারবাজারে থাকা ২৩টি বিও অ্যাকাউন্ট। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মতিউর, তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয় ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের নামে খোলা হয়েছিল। ২৩টি ব্যাংকে তাদের নামে ছিল ১১৬টি অ্যাকাউন্ট। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে রয়েছে ৬টি অ্যাকাউন্ট, এনআর?বিসি ব্যাংকে ২টি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১২টি, জনতা ব্যাংকে ১টি, ব্র্যাক ব্যাংকে ৬টি, এসসিবি? ব্যাংকে ২টি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ১টি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২টি, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ৬টি, কমিউনিটি ব্যাংকে ১টি, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ২টি, সাউথইস্ট ব্যাংকে ১টি, মিডল্যান্ড ব্যাংকে ১টি, ইউসিবি ব্যাংকে ১টি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে ১৫টি, বিকাশ লিমিটেডে ৩টি, ওয়ান ব্যাংকে ৩৯টি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২টি, এসবিএসি ব্যাংকে ১টি, এক্সিম ব্যাংকে ১টি, অগ্রণী ব্যাংকে ৪টি, মধুমতি ব্যাংকে ২টি, ঢাকা ব্যাংকে ৪টি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১টি অ্যাকাউন্ট।
এ ছাড়া শেয়ারবাজারে থাকা ১২টি প্রতিষ্ঠানে ২৩টি বিও অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে রয়েছে- আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ৪টি, রূপালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি, শাহজালাল ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডে ২টি, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডে ২টি, ইমতিয়াজ হোসাইন সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ৪টি, শান্তা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ৩টি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ২টি, ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি, সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডে ১টি, লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি, এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিস লিমিটেডে ১টি এবং সোনালী সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি অ্যাকাউন্ট। উল্লেখ্য, প্রথম দফায় জব্দের আদেশ দেওয়া সম্পত্তিগুলোর মধ্যে ছিল, বরিশালে মুলাদী উপজেলায় মতিউরের নামে থাকা ১১৪ শতাংশ জমি। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মারজাল ইউনিয়নের ৫২২.৫২ শতাংশ জমি ও মতিউরের ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে থাকা ২৭৫.৮৫ শতাংশ জমি।
এ ছাড়াও সেদিন জব্দের আদেশ দেওয়া সম্পত্তির মধ্যে আরও রয়েছে- নরসিংদীর রায়পুরায় মতিউর-লায়লা দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতার ১০৬.৫৬ শতাংশ জমি ও ঢাকার বসুন্ধরায় ৫ কাঠা জমির ওপর বহুতল ভবন। মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতারের বসুন্ধরায় ৫ কাঠা জমি। এসব স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০.৩৫ একর বা ১ হাজার ৩৫ শতাংশ। জব্দের মধ্যে ছিল- মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ভাটারায় তিনটি ফ্ল্যাট এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর নামে জিগাতলার একটি ফ্ল্যাট। এদিকে গত ২৪ জুন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাদের পুত্র আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবকে (ইফাত) বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন। এরপর ৩০ জুন এ বিদেশযাত্রা প্রত্যাহার চেয়ে আদালতে আবেদন করেন লায়লা কানিজ। আগামী ২৮ জুলাই এ বিষয়ে আদালতে শুনানি হওয়ার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। ছাগলকান্ডে আলোচিত ইফাতের বাবা জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের সদস্য মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চারবার অনুসন্ধান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবারই অনুসন্ধান পর্যায় থেকে শেষ হয়েছে কার্যক্রম। সম্প্রতি মতিউরের বিরুদ্ধে ফের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এদিকে এরই মধ্যে মতিউর রহমান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে গেছে। ঈদুল আজহার আগে ইফাত নামের এক তরুণ কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সবাই খুঁজতে থাকেন এত টাকার উৎস কী? তখনই সামনে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তা মতিউর রহমানের নাম। যদিও একপর্যায়ে নিজের ছেলেকেও অস্বীকার করেন মতিউর। আলোচিত সেই ঘটনার পর আর শেষ রক্ষা হয়নি মতিউরের। এনবিআরের পদ থেকে সরিয়ে তাকে সংযুক্ত করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে।