এবার বিতর্কিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের অর্থ পাচার অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সংস্থা দুটির সূত্র বলছে, ভোগ্যপণ্যের কৃত্রিমসংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেট করে বাজার কারসাজিতে জড়িত মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত জমা পড়েছে। মেঘনা গ্রুপের অর্থ পাচার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাইবাছাই চলছে। এর পরই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মেঘনা গ্রুপের অর্থ পাচার তদন্তে রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মেঘনা গ্রুপ পণ্য আমদানির আড়ালে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে, এমন তথ্য রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি মেঘনা গ্রুপের ৭০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে পাঁচটি সুপারিশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি ধরেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
সম্প্রতি এনবিআরকে দেওয়া ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল তার মালিকনাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে করা এলসি বা ঋণপত্র রিফান্ড করার মাধ্যমে বিমা কোম্পানি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পরে এই টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি সরকারি রাজস্ব ফাঁকির আশঙ্কা রয়েছে বলে অনুমেয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান জরুরি বলে মনে করছে ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পাঁচটি সুপারিশে বলা হয়- এক. মেঘনা গ্রুপের ৭০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে বছরভিত্তিক ও শ্রেণিভিত্তিক পরিশোধিত বিমা দাবির পরিমাণ। দুই. ইস্যু করা কভারনোট বা পলিসির সংখ্যা ও প্রিমিয়াম এবং আদায় করা প্রিমিয়ামের পরিমাণ। তিন. ইস্যু করা পলিসিগুলোর বিপরীতে বাতিল ও ফেরত প্রিমিয়ামের পরিমাণের তালিকা। চার. সাধারণ বিমা বা বিদেশি পুনঃবিমাকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় হওয়া বিমা দাবির পরিমাণ। পাঁচ. বিমা দাবি পরিশোধের চেকগুলোর ব্যাংক হিসাব ইত্যাদি যাচাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছে ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি। একই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মোস্তফা কামাল ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে আমদানিতে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্কায়নযোগ্য পণ্য-মোটরযান-নৌযানের বিপরীতে বাধ্যতামূলক বিমা পলিসি গ্রহণ না করে ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের ১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, সরকারের ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি ও ব্যাংক কমিশনের ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন।
ব্যবসায়ে রাতারাতি বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জনের নেশায় তিনি বেছে নিয়েছেন সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কম খরচে আমদানি। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে তিনি আমদানিকৃত পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক টাকা কমিয়ে দেখাতেন। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে অন্যদিকে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অনেক কমে পণ্য কেনায় বেশি লাভ করতে পারতেন তিনি।
আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যবসায়িক লাভের হিসাব। উদাহরনস্বরূপ- একজন ব্যবসায়ী একটি পণ্য ১ হাজার ডলারে কিনে আনছেন। কিন্তু পণ্যটির মূল্য ঘোষণা করছেন ১০০ ডলার। এতে করে সরকার ১০০ ডলারের ওপর রাজস্ব পাবে। বাকি ৯০০ ডলারের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে আমদানিকারক পণ্যটি সম্পূর্ণ রাজস্ব দেওয়ার পর যেই মূল্য দাঁড়াত তার সঙ্গে লাভ যুক্ত করে বিক্রি করল। এতে সরকারকে ঠকিয়ে দ্রুত অধিক টাকা উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়।
প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থাটি বলেছে, আলোচ্য সময়ে মেঘনা গ্রুপ ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩১ কোটি ৩৩ লাখ ২১ হাজার ১২৬ টাকা শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের আমদানি করেছে। তবে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) অনুযায়ী ইনভয়েজ মূল্য ছিল ৪৮ হাজার ৩৬৮ কোটি ৪২ লাখ ৪২ হাজার ৩১১ টাকা। সে হিসেবে আমদানির আড়ালে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি ৯০ লাখ ৭৮ হাজার ৮১৫ টাকার অতিরিক্ত সুবিধা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাট করা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে গ্রুপটির। তবে করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে আমদানি উল্লেখযোগ্যহারে কমে যাওয়ায় সে বছর কমেছে এর পরিমাণ। ২০২০ সালে এলসি ও শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের পার্থক্য ছিল ২৬৪ কোটি টাকা। অথচ এর আগের তিন বছর এর পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ছিল। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সরকার এবং প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিমা কোম্পানির পলিসিও পরিশোধ করেনি মেঘনা গ্রুপ। প্রতিবেদন বলছে, শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের বিপরীতে পলিসি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সেখানে পলিসির হার ছিল ০.৯০ শতাংশ। কিন্তু শুল্কায়নযোগ্য ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩১ কোটি ৩৩ লাখ ২১ হাজার ১২৬ টাকার বিপরীতে পলিসির ১ হাজার ১৫৩ কোটি ১৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৯০ টাকা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোস্তফা কামালের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৬০-৭০টি নৌযান ও হাজার-বারো শ মোটরযানের বিপরীতে বিমা পলিসি বাধ্যতামূলক থাকলেও পলিসির ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক কমিশনের ৬৩৮ কোটি ১০ লাখ ৩২ হাজার ৬৩০ টাকা এবং বিমা পলিসির বিপরীতে ৪ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটির ২৫ কোটি ৫২ লাখ ৪১ হাজার ৩০৫ টাকা পরিশোধ করেনি মেঘনা গ্রুপ। ব্যাংক কমিশনের শতকরা ১৫ শতাংশ টাকা ভ্যাট হিসেবে পাওয়ার কথা সরকারের। তবে ভ্যাটের ৯৫ কোটি ৭১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮৪ টাকা খেয়ে দিয়েছে গ্রুপটি। বিভিন্ন খাতে সরকারের ভ্যাট ও স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ৪০৫ কোটি টাকা পকেটে পুরে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোস্তফা কামাল তার গ্রুপের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে করা এলসি রিফান্ড করার মাধ্যমে বিমা কোম্পানি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পরে এই টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের বিপুল টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব ফাঁকির আশঙ্কা থাকায় এনবিআরকে অনুসন্ধানের অনুরোধ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন এর উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন মো. জাকারিয়া, তার ভাই এম এফ কামাল ও তাদের বোন বিউটি আক্তার, বোনের স্বামী মোস্তফা কামাল এবং বাসেত মজুমদার। বর্তমানে বিমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মোস্তফা কামাল এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সানা উল্লাহ। ২০০০ সাল পর্যন্ত বিমা কোম্পানিটি তাদের ব্যবসা কার্যক্রম ভালোভাবে পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ দুভাগে বিভক্ত হয়।