নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল ২১ আগস্ট আজ। বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস ‘রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের’ ২০তম বার্ষিকী। ২০০৪ সালের এই দিনে মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল-পূর্ব সমাবেশে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা এবং গুলিবর্ষণ করে ঘাতকরা।
এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। কেউ কেউ আজও ফিরে পাননি স্বাভাবিক জীবন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক সমাবেশে এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া বিরল।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত শহিদ বেদিতে প্রতি বছর পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হতো। এবার কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ। প্রতি বছর আলোচনা সভা করলেও এবার তাও হচ্ছে না। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দলের ভেরিফাইড পেজের কভার ফটো পরিবর্তন করা হয়। সেখানে ভয়াল ২১ আগস্ট লেখা রয়েছে। তাছাড়া বিকেলের দিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়।
এদিকে প্রতি বছর ২১ আগস্ট উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বাণী দিলেও এবার তা হয়নি। আর ছাত্র আন্দোলনের কারণে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভয়াবহ সেই হামলা বাঙালি জাতি কোনো দিনও ভুলবে না। ২০০৪ সালের পর থেকে তাই দিনটি ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ-১৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, ২১ আগস্টের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা।
সেদিন যা ঘটেছিল : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচি ঘিরে বিকাল ৪টার আগেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষে কানায় কানায় ভরে ওঠে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি খোলা ট্রাকে (ঢাকা মেট্টো-ট-১১-৩০৯৮) বানানো উন্মুক্ত মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
বিকাল ৫টার দিকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে সমাবেশস্থলে পৌঁছেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ট্রাকে তার সঙ্গে প্রয়াত জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আবদুল জলিল, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর নেতানেত্রী ছিলেন।
প্রায় ২০ মিনিট বক্তৃতা দেন শেখ হাসিনা। সময় তখন বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোতে থাকলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। কয়েকজন ফটোসাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে একটু দাঁড়াতে বললেন ছবি তোলার জন্য। মুহূর্তেই শুরু হলো নারকীয় গ্রেনেড হামলা। দফায় দফায় বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। হামলার লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশ।
হঠাৎ সমাবেশস্থলের দক্ষিণ দিক থেকে মঞ্চ লক্ষ্য করে ছোড়া হয় গ্রেনেড। সেদিন শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আকস্মিক এসব গ্রেনেড নিক্ষেপ ও বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রক্তাক্ত মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সে সময়ে দলীয় নেতারা এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাৎক্ষণিকভাবে এক মানববলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন। হামলায় অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তির গুরুতর ক্ষতি হয়।
নিহত যারা : সেদিনের সেই ঘটনায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এই বর্বরোচিত হামলায় নিহত অন্যরা হলেন-প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া প্রমুখ। সেই হামলায় আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়ে শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আহত হয়েছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাও। তাদের অনেকেই এখনো গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।