ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের এই সময়ে হল প্রাধ্যক্ষরা হলের অফিসও বন্ধ রাখবেন, বন্ধ থাকবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিও। অনলাইন, সান্ধ্যকালীন ক্লাস এমনকি শুক্র ও শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের কার্যক্রমও চলবে না। মিডটার্ম, ফাইনাল, মৌখিক ও ভর্তি পরীক্ষাসহ কোনো পরীক্ষাই অনুষ্ঠিত হবে না। বিভাগীয় অফিস, সেমিনার, কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগারের তালাও খুলবে না। অনুষ্ঠিত হবে না কোনো একাডেমিক বা অন্য কোনো কমিটির সভাও। সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া এ অচলাবস্থার কারণে সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা বলছেন, প্রত্যয় স্কিম সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের পাশাপাশি সুপারগ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিও রয়েছে এ আন্দোলনের পেছনে। তারা বলছেন, এসব দাবি আদায়ে শিক্ষকরা বিবৃতি প্রদান, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, প্রতীকী কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচির মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছেন। এ ছাড়া গত ২৫, ২৬ ও ২৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্ধ দিবস কর্মবিরতি পালন করা হয়েছে। গতকাল পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকরা। এরপরও শিক্ষকদের দাবি আদায়ে কোনো কর্ণপাত করতে দেখা যায়নি সরকারকে। তাই বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউনের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রত্যয় পেনশন স্কিম বাতিলসহ শিক্ষকদের দাবিগুলো মেনে না নিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘শাটডাউন’ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে। আশা করি সরকার অবিলম্বে দাবি মেনে নেবে যাতে দ্রুত আমরা ক্লাসে ফিরতে পারি। ফেডারেশনের সংবাদ সম্মেলনে গতকাল শিক্ষক নেতারা বলেন, প্রস্তাবিত প্রত্যয় স্কিম বাস্তবায়ন করা হলে মেধাবীরা ভবিষ্যতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না। যারা আসবেন তারাও ভুক্তভোগী হবেন। আমাদের আন্দোলন তরুণ সমাজের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে এবং উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। আন্দোলনরত শিক্ষকরা জানান, গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, যেসব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর থেকে যোগ দেবেন তাদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার জন্য বিদ্যমান অবসর সুবিধা সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে না। শিক্ষকদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না। তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিল দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে, যেটা আগে কাটা হতো না। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সেটিও সুস্পষ্ট করা হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতাও নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না বলে জানা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, দাবি আদায়ে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আজ থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাসে যাবেন না। কোনো দাফতরিক কাজে অংশ নেবেন না। আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া প্রত্যয় স্কিম বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কলম-বই নিয়েই ক্লাসরুমে থাকতে চান। কিন্তু আরোপিত অন্যায় প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুরক্ষা বলয় নিশ্চিত করতে হবে, এই প্রত্যয় স্কিম বাতিল করতে হবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মামুনুর রহমান গতকাল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বৈষম্যমূলক। আমরা আশা করব দ্রুত সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে এই পেনশন স্কিম প্রত্যাহার করবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকরা জানান, সর্বজনীন পেনশন স্কিম সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে আজ থেকে সব বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শিক্ষক নেতারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন। বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি পালিত হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে আজ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মমিন উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মাশরিক হাসান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দাবি আদায়ে গতকাল পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালিত হয়েছে।
গতকাল সরেজমিন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী দফতর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতর, ডিন অফিসসহ বিভাগগুলোর অফিস রুমের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ দফতর ছেড়ে অফিস সময়ে ক্যাম্পাসের ভাস্কর্য চত্বরের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এ সময় বেশির ভাগ দফতরেই তালা ঝুলিয়ে দেন কর্মকর্তারা। রাজশাহী শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পেনশন নীতিমালা প্রত্যাহারের দাবিতে গত দুই মাস থেকে শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সরকার এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেননি। যা শিক্ষকদের হতাশ করেছে।
এদিকে পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে আজ থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন শেষে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা। এ বিষয়ে জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. মোতাহার হোসেন বলেন, কর্মসূচি পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের শ্রেণি কার্যক্রম, পরীক্ষা এবং দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
দাবি আদায়ে গতকাল পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা। প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রত্যয় স্কিম বাতিলের যুক্তি তুলে ধরেন তারা। আজ থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা।
পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত- শিক্ষামন্ত্রী : সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা তৈরি হলে আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তীতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেহেতু সর্বজনীন পেনশনের সিদ্ধান্তটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়, সেহেতু এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন কিংবা এর পক্ষে-বিপক্ষে আপাতত কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। গতকাল বিকালে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা-২০২৪ সংক্রান্ত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, সর্বজনীন পেনশনে যেতে কেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অনীহা প্রকাশ করেছেন সেটা নিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে তুলনামূলক একটি চিত্র দেখিয়েছেন। সেখানে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে নানান ধরনের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছি। সেগুলো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, এটি অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত এবং সরকারের সার্বিক পলিসির ডিসিশনের একটি অংশ। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন এবং এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মন্তব্য করা আপাতত সম্ভব নয়। কারণ সেটি (সর্বজনীন পেনশন) স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদাভাবে বিবেচনার জন্য একটি আলোচনা এসেছে, সেটি আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে উপস্থাপন করতে পারি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়া নিয়ে আমি এ মুহূর্তে কিছু বলছি না। এ অচলাবস্থা শুরু হলে আমরা পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবস্থা নেব।