গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বলে বৈঠকের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদ অর্জনের বিষয় সামনে আসার পর বিভিন্ন কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। সব ছাপিয়ে যায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমানের ছেলের ১৫ লাখ টাকার ছাগলকাণ্ডে। এতে করে এনবিআর কর্মকর্তার অবৈধ হাজার কোটি টাকা সম্পদ অর্জনের ঘটনা সামনে আসে। একের পর এক সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি চিত্রে আলোড়ন উঠেছে দেশব্যাপী। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা বের হলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক সম্পর্কে মন্ত্রিসভার এক সদস্য বলেন, সরকার দুর্নীতির বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল এটি প্রধানমন্ত্রীর সাফ কথা। মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতির এসব ঘটনায় যারা জড়িত কাউকে ছাড় দেব না আমি। তবে কারও নাম বলেননি প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না সেটিই বলেছেন তিনি।
ওই বৈঠকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সময়টায় আমাদের বিরুদ্ধে অনেকেই প্রপাগান্ডা আনছে, এসবের জবাব দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা দেশ বিক্রি করিনি। প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে জবাব দিতে হবে। এ সময় বিএনপির বিভিন্ন সময় নতজানু পররাষ্ট্র বিষয় নিয়েও আলোচনা হয় বলে জানা যায়। সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ জানে ১০ ট্রাক অস্ত্র কারা এনেছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া, পরেশ বড়ুয়াদের কারা শেল্টার দিয়েছিল। কারা ইন্দিরা গান্ধীর পায়ের কাছে বসেছিল, রাজীব গান্ধীর হাত ধরেছিল। এ সব নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৯৭২ সালে ২৫ বছরের চুক্তিকে যারা গোলামি চুক্তির কথা বলেছিল, সে চুক্তির ফলে যে সুফল এসেছে সেসব বিষয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। ভারতের সঙ্গে এবারের চুক্তিও অনেক সুফল মিলবে বলে জানায় বৈঠকসূত্র।
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সহযোগিতা করছে প্রশাসন : মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, প্রশাসনসহ প্রত্যেকেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সবসময়ই সহযোগিতা করছে। প্রশাসনের হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তা দুর্নীতি করে, আর বাকি সবাই বিব্রত হয়। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে যত্ন ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পাস হওয়া নতুন অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেট বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী একটি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। সেটি হলো সবাই যেন খুব যত্নের সঙ্গে ও নজরদারির মধ্য দিয়ে বাজেট বাস্তবায়নে মনোযোগ দেন। নিপুণতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যেন বাজেট বাস্তবায়ন হয়, সে বিষয়ে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী ও সচিব সবাইকে তিনি বলেছেন, বাজেট সঠিকভাবে বাস্তবায়নে যাতে আমরা সবাই মনোনিবেশ করি। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমি জানি না, একটা বিষয় আপনারা আমার সঙ্গে স্বীকার করবেন কি না, দুর্নীতি তো সবাই করে না। হাতেগোনা কয়েকজন করে। ওই কয়েকজনের জন্য বাকি সবাই বিব্রত হয়। অবস্থা তো তাই দাঁড়িয়েছে, তাই না? তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অবস্থানটা পরিষ্কার হয়েছে যে, দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিষয়ে কোনো সহানুভূতি দেখানো হবে না এবং দেখানো হচ্ছে না। এটা আপনারা খেয়াল করেছেন। যাদের দুষ্ট চিন্তার মানসিকতা, যাদের দুষ্ট বুদ্ধির মানসিকতা, তারা এই (দুর্নীতি) কাজগুলো করতে চান। যখনই এ বিষয়টি সরকারের নজরে আসে, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।
মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভাগগুলোয় দুর্নীতি হয় বলে একজন সাবেক আমলার বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সচিবরা এ বিষয়ে ভালো উত্তর দিতে পারবেন। তিনি বলেন, কোথাও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এমন কোনো বিষয় থাকলে আমার নজরে আনেন। আমি আবার তদন্তের ব্যবস্থা করব।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মাদারীপুরের শিবচরে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে চায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি)। তবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নামে এটি স্থাপনের বিষয়ে ‘না’ বলেছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে হচ্ছে ‘ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি’। তিনি বলেন, এটির একটি গভর্নিং বর্ডি থাকবে এবং একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকবেন। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া ‘পদ্মা ব্রিজ অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স কোম্পানি পিএলসি’ শিরোনামে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন হবে ১ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানির মূল দায়িত্ব থাকবে পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ। কোম্পানির ১৪ জনের বোর্ড অব ডিরেক্টর থাকবে। রেল মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ ও সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে প্রতিনিধি থাকবেন। কোম্পানি আইন অনুযায়ী তারা চলবে এবং জনবল কাঠামো তারা অনুমোদন দেবে। বর্তমানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থাকা চুক্তি শেষ হওয়ার পরই কোম্পানি বাস্তবায়ন হবে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে রপ্তানি নীতি, ২০২৪-২৭ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মাহবুব হোসেন বলেন, প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর আমরা রপ্তানি নীতি করে থাকি। আগের রপ্তানি নীতি শেষ হয়েছে। নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে। আগের নীতির ধারাবাহিকতায় নতুন নীতিতে কিছু বিশেষ বিষয় যোগ করা হয়েছে। গত বছর ৮০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল জানিয়ে মাহবুব হোসেন বলেন, এ অর্থবছরটা এখনো হিসাব করা হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এ পর্যন্ত ৬৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে। এবার তারা আশা করছেন ৭০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস রপ্তানির জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা এতকাল সফটওয়্যার রপ্তানিতে জোর দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা শুধু সফটওয়্যার না, আমাদের যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সেটি রপ্তানিতেও যেন আমরা বেশি উৎসাহ প্রদান করি। সেখানে যাতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।